Showing posts with label স্বাধীনতা যুদ্ধ. Show all posts
Showing posts with label স্বাধীনতা যুদ্ধ. Show all posts

Saturday, June 29, 2019

ইতিহাস মুছে ফেল্লেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বোচ্চ অবদান ছিলো মুসলমানদের!

                          
                                    রণবীর ভট্টাচার্য, লেখেছেন ভারত থেকে।।


 ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নাকি মুসলিমদের কোনো অবদান নেই। সেদেশের যেকোনো শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক পড়লে সেটাই বোঝা যায়। আর এই মিথ্যাচারমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বহু উগ্রপন্থী হিন্দুই প্রশ্ন তোলেন যে মুসলমানদের এই দেশে থাকা উচিত নয়। কারণ তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। মূলত এই বিষয়কে সামনে রেখেই আমার আজকের এই লেখা। সত্য ইতিহাস বলছে, মুসলিমদের তাজা রক্তে ভারত মুক্তি পেয়েছে। জেল খাটা ১ কোটি মুসলমানের আত্ম বলিদান ও ফাঁসি হওয়া ৫ লাখ মুসলমানের প্রাণের বিনিময়ে আজ ভারত স্বাধীন। সেই চেপে যাওয়া ইতিহাসের মুছে যাওয়া কিছু নাম আমি শেয়ার করলাম।
মাওলানা কাসেম সাহেব, উত্তর প্রদেশর দেওবন্ধ মাদ্রাসাকে ব্রিটিশবিরোধী এক শক্তিশালী কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। সেই দেওবন্দ মাদ্রাসায় আজও কুরয়ানের তালিম দেওয়া হয়। ভারতের ইতিহাসের পাতা ওল্টালে যাদের নাম অবশ্যই পাওয়া যায় তারা হলো– গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র, অরবিন্দ, জোহরলাল, মতিলাল, প্রমুখ…। কিন্তু এদের চেয়েও বেশী বা সমতুল্য নেতা আতাউল্লাহ বুখারী, মাওলানা হুসেন আহমাদ, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মাওলানা গোলাম হোসেন প্রমুখ..(এনারা বহু বার দীর্ঘ মেয়াদী জেল খেটেছেন) তাদের নাম ভারতের ইতিহাসে নাই। ইংরেজ বিরোধী কর্যকলাপের জন্য যার নামে সর্বদা ওয়ারেন্ট থাকতো। সেই তাবারক হোসেনের নামও ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না।

তৎকালিন সময়ে সারা হিন্দুস্থানের কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যার সংস্পর্শে আসলে হিন্দু-মুসলিম নব প্রান খুজে পেতেন, সেই হাকিম আজমল খাঁ কে লেখক বোধ হয় ভূলে গিয়েছেন। মহাত্মা গান্ধী, জহরলাল যার সাহায্য ছাড়া চলতে পারতেন ই না। যিনি না থাকলে গান্ধী উপাধিটুকু পেতেন না। সেই মাওলানা আজাদকে পর্যন্ত ইতিহাসের পাতা থেকে বাদ দেওয়া হল। মাওলানা মুহম্মদ আলি ও শওকত আলি। ৫ বার দীর্ঘ মেয়াদী জেল খেটেছেন। ‘কমরেড’ ও ‘হামদর্দ’ নামক দুটি ইংরেজ বিরোধী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাদের নাম ভারতের ইতিহাসের ছেড়া পাতায় জায়গা পায় না । খাজা আব্দুল মজীদ ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টার হন। জহরলালের সমসাময়িক কংগ্রেসের কর্মী ছিলেন। প্রচন্ড সংগ্রাম করার ফলে তার এবং তার স্ত্রী উভয়ের জেল হয়। ১৯৬২ সালে তার মৃত্যু হয়। ইতিহাসের পাতায়ও তাঁদের নামের মৃত্যু ঘটেছে। ডবল অ.গ এবং চ.ঐ.উ ডিগ্রিধারী প্রভাবশালী জেল খাটা সংগ্রামী সাইফুদ্দিন কিচলু। বিপ্লবী মীর কাশেম, টিপু সুলতান, মজনু শা, ইউসুফÑ তারা ব্রিটিশদের বুলেটের আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও ইতিহাসের পাতা থেকে নিশ্চিহ্ন হলো কীভাবে? সর্ব ভারতীয় নেতা আহমাদুল্লাহ।

তৎকালীন সময়ে ৫০ হাজার রুপি যার মাথার ধার্য করেছিল ব্রিটিশরা। জমিদার জগন্নাথ বাবু প্রতারণা করে, বিষ মাখানো পান খাওয়ালেন নিজের ঘরে বসিয়ে। আর পূর্ব ঘোষিত ৫০ হাজার রুপি পুরস্কার জিতে নিলেন। মাওলানা রশিদ আহমদ। যাকে নির্মম ভাবে ফাঁসি দিয়ে পৃথিবী থেকে মুছে দিলো ইংরেজরা। ইতিহাসলেখক কেন তার নাম মুছে দিলেন ইতিহাস থেকে। জেল খাটা নেতা ইউসুফ, নাসিম খান, গাজি বাবা ইয়াসিন ওমর খান তাদের নাম আজ ইতিহাসে নেই কেন? ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পরে, কুদরতুল্লাহ খানে মৃত্যু হলো কারাগারে। ইতিহাসের পাতায় নেই তার মৃত্যু ঘটলো কীভাবে? সুভাষ চন্দ্র বসুর ডান হাত আর বাম হাত যারা ছিলেন..। ইতিহাসে তাদের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা হলেন আবিদ হাসান শাহনাওয়াজ খান, আজিজ আহমাদ, ডিএম খান, আব্দুল করিম গনি, লেফট্যানেন্ট কর্নেল, জেট কিলানি, কর্নেল জ্বিলানী প্রমুখ..। এদের অবদান কী করে ভুলে গেলেন? বিদ্রোহী গোলাম রব্বানী, সর্দার ও হয়দার, মাওলানা আক্রম খাঁ, সৈয়দ গিয়াসুদ্দিন আনসার। এদের খুন আর নির্মম মৃত্যু কি ভারতের স্বাধীনতায় কাজে লাগেনি? বিখ্যাত নেতা জহুরুল হাসানকে হত্যা করলে মোটা অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করে ইংরেজ সরকার। মাওলানা হজরত মুহানী এমন এক নেতা, তিনি তোলেন সর্ব প্রথম ব্রিটিশ বিহীন চাই স্বাধীনতা।
জেলে মরে-পচে গেলেন মাওলানা ওবায়দুল্লাহ, তার নাম কি ইতিহাসে ওঠার মতো নয়!? হাফেজ নিশার আলি যিনি তিতুমীর নামে খ্যাত ব্রিটিশরা তার বাঁশেরকেল্লাসহ তাকে ধংব্বস করে দেয়। তার সেনাপতি গোলাম মাসুমকে কেল্লার সামনে ফাঁসি দেওয়া হয়। কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে ব্যার্থ ক্ষুদিরামের নাম আমরা সবাই জানি, কিংসফোর্ড হত্যাকরী সফল শের আলী বিপ্লবীকে আমরা কেউ জানি না। কলকাতার হিংস্র বিচারপতি জর্জ নরম্যান হত্যাকরী আব্দুল্লাহর নামও শের আলীর মতো বিলীন হয়ে আছে..। বিখ্যাত নেতা আসফাকুল্লাহ। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বীর আব্দুস সুকুর ও আব্দুল্লা মীর এদের অবদান কি ঐতিহাসিকরা ভুলে গেছেন? সূত্র : স্বদেশ বার্তা।

Thursday, May 23, 2019

প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ : ফকীর বিদ্রোহ - আ বু সা ঈ দ মু হা ম্ম দ ও ম র আ লী


উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কে বা কারা প্রথম শুরু করে এবং কখন তা শুরু হয়, এককালে তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বাংলার ‘ফকীর বিদ্রোহের ইতিহাস’ উদ্ঘাটিত হবার পর এ বিতর্কের একটা সুরাহা হয়েছে বলেই আমাদের ধারণা। বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষাণার প্রয়োজন যে নেই তা নয়, বরং আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিপূর্ণ ইতিহাস রচনার স্বার্থেই সে ইতিহাস খুঁজে বের করবার প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তী স্তরগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘটিত ‘ত্রিপুরার শমশের গাজীর বিদ্রোহ’, ‘সিরাজগঞ্জের বিদ্রোহ’, ওহাবী আন্দোলন’, ‘ফারায়েজী আন্দোলন’, স›দ্বীপের বিদ্রোহ’, ‘১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব’ ও ‘নীল বিদ্রোহের’ পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সংকলন করা দরকার, দরকার তা ভবিষ্যৎ বংশদরদের হাতে তুলে দেবার।
সুদীর্ঘ ৭০০ বছল ধরে ভারতের বুকে যে মুসলিম শাসন অব্যাহত ছিল- পলাশীর বিয়োগান্ত প্রহসনের মাধ্যমে তার হাতবদল মুসলমানরা স্বাভাবিক কারণেই মেনে নিতে পারেনি। মেনে নেয়া সম্ভবও ছিল না। আর কোনো আত্ম-মর্যাদাসম্পন্ন জাতির পক্ষেই রাতারাতি এই পরিবর্তনকে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। পলাশীর আম্রকাননের আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত এই ভাগ্য বিপর্যয়ে বাংলার মুসলমান সাময়িকভাবে দিশেহারা ও মুহ্যমান হয়ে পড়লেও সম্বিৎ ফিরে পেতে তাদের বেশি দেরিও হয়নি। সিরাজউদ্দৌলার পর শাসকদের পক্ষ থেকে মীর কাসেম আপ্রাণ চেষ্টা চালান দেশের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে। কিন্তু তাঁর এ চেষ্টা ফলবতী হয়নি। পরাধীনতার অভিপাশ সম্বন্ধে জনগণের চেতনা প্রথমেই জাগেনি। তার কারণ প্রথম দিকে আপামর জনসাধারণে একে শাসকের পালাবদল হিসেবে ধরে নিলেও মাত্র কিছুদিননের ভেতরই তারেদ সামনে এ সত্যও ধরা পড়ল- শাসকের পালাবদলের সংগে তাদের ভাগ্যেরও পালাবদল ঘটেছে। আর এই সত্য উপলব্ধির সংগেই শুরু হল প্রতিরোধ সংগ্রাম। ব্রিটিশ শাসকেরা একে বিদ্রোহ বলে চালাতে চাইলেও এবং এসব বিদ্রোহকে (অবশ্য তাদের ভাষায়) নির্মম হস্তে দমন করতে সমর্থ হলেও স্বাধীনতাকামী সুসলমানদের কাছে তা স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবেই সম্মান ও শ্রদ্ধার সংগে স্মরণীয় হয়ে রইল-আর সেসব ‘বিদ্রোহ’ (?) যারা অংশ নিতে এগিয়ে গেলেন, নির্যাতন সইলেন, প্রাণ বিলিয়ে দিলেন, সা¤্রাজ্যবাদী শাসক ও শোষকদের লেখায় তারা দস্যু, তস্কর, লুটেরা ও সন্ত্রাসীবাদী হিসেবে আখ্যায়িতত হলেও এদেশের মানুষ কিন্তু তাদের ঠিকই স্বাধীনতার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অমর শহীদ হিসেবেই হৃদয়ে ঠাঁই দিলো।
এখানে অনিবার্যভাবেই একটি প্রশ্ন মনে না জেগে পারে না তাহল- পলাশী প্রহসন অনুষ্ঠিত হবার যে দিনটিতে অক্রকাননের কিছু দূরেই ভূমি কর্ষণরত যে কৃষকের হাতে লাঙলের মুঠি ধরা রইল, এতটুকু ভাবান্তর যাবে বিব্রত করল না, -হস্তীপৃষ্ঠে শহীদ সিরাজের লাশ দৃষ্টেও যে মুর্ষিদাবাদবাসী ফ্যাফফ্যাল করে চেয়ে রইল, লাশ বহনকারী হাতীর সামনে আলুথালুবেশী নবাব মাতা আমিনার ভূলুণ্ঠিত চেহারা যাদের চোখের কোণে এক বিন্দু অশ্রæ ভিন্ন আর কিছু দিতে পারল না, হঠাৎ এমন কি ঘটল যে, সেই লাঙলের মুঠি ধরা হাতই প্রতিরোধের শাণিত অস্ত্র তুলে নিল? সে এক ইতিহাস; বড় করুণ, বড় নির্মম।
ষড়যন্ত্র এবং কূটকৌশলের মাধ্যমে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ক্ষমতা দখল করলেও দেশের উপর সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপন করতে তারা প্রথমেই সাহসী হয়নি। সাত-সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপারের সাদা চামড়ার শাসন এদেশবাসী সহজে কিংবা আদৌ মানবে কিনা এই ভয় তাদের গোড়াতেই ছিল। নির্লজ্জ শোষক ও লোভী হায়েনার চেহারা নিয়ে হঠাৎ করে দেশের সাধারণ মানুষের সামনে হাজির হতে প্রথমে তাদের সংকোচ বেধেছিল। তাই তারা মীরজাফর প্রমুখ কতিপয় সাক্ষী-গোপালের আড়ালে নিজেদের হিংস্র ও লোভী চেহারা লুকিয়ে রাখার ভেতর নিজেদেরকে নিরাপদ ভেবেছিল। পর্দার আড়ালে থেকে চালিয়ে যেতে থাকল শাসন, শোষণ এবং উৎপীড়ন। বাংলার অফুরন্ত ধন-সম্পদ লুট করবার মূল চাবিকাঠি কোম্পানী নিজ হাতে রেখে এদেশের মানুষের অর্বণনীয় দুঃখ-কষ্টের কারণ হিসেবে এদেশের কতিপয় কুলাংগারের মাথায় সব দোষের বোঝা তুলে দিলো। রবার্ট ক্লাইভ সব অপকর্মের নায়ক হয়েও চতুর্যের বদৌলতে ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে রইলেন।
“বিজয়ের সাথে সাথে ক্লাইভ ও তার অনুচরেরা সমগ্র দেশের কায়েম করল লুণ্ঠন ও অত্যাচারের বিভীষিকা। পলাশী যুদ্ধের পর ক্লাইভ মীরজাফরের নিকট থেকে উৎকোচ স্বরূপ লাভ করলেন দু’লক্ষ চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড। রাতারাতি লর্ড ক্লাইভ গণ্য হলেন ইংল্যান্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী বলে। নবাবী লাভের ইনাম স্বরূপ মীরজাফরের কাছ থেকে কোম্পানির কর্মচারীরা গ্রহণ করলো ৩০ লক্ষ পাউন্ড এবং চব্বিশ পরগণা জেলার জমিদারী। এরপর একটানা চললো উৎকোচ গ্রহণ, লুণ্ঠন ও ক্রমবর্ধমান হারে রাজস্ব আদায়। ১৭৬৬ সালে (ব্রিটিশ) পার্লামেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত অনুসন্ধান কমিটি ইংরেজ কর্মচারীদের উৎকোচ গ্রহণের যে তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন তাতে দেখা যায়, “১৭৫৭ সাল থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্চচারীরা বাংলাদেশ ও বিহার থেকে মোট ৯ কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেছিল।”
লুণ্ঠনের এমন দুঃখজনক ইতিহাস দুনিয়াতে বোধকরি অল্পই আছে। এই শোষণ-নির্যাতনের রূপ যে কত ঘৃণীত ও ভয়াবহ ছিল তা তাদেরই একজন লর্ড মেকলের ভাষায় শুনুন;
‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী স্বার্থে নয়, নিজেদের জন্যই কোম্পানির কর্মচারীরা এদেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যক্ষেত্রে নিজেদের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। দেশীয় লোকদের তারা দেশীয় উৎপন্ন দ্রব্য অল্প দামে বিক্রয় এবং ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্য বেশি দামে ক্রয় করতে বাধ্য করলো। কোম্পানির আশ্রয়ে প্রতিপালিত দেশীয় কর্মচারীরা সমগ্র দেশে সৃষ্টি করেছিল শোষণ ও অত্যাচারের ভয়াবহ বিভীষিকা। কোম্পানির প্রতিটি কর্মচারী ছিল তার প্রভুর শক্তিতে শক্তিমান, আর এইসব প্রভুর শক্তির উৎস ছিল স্বয়ং ইষ্ট ইন্ডি’া কোম্পানি। কোলকাতায় ধন-সম্পদের পাহাড় তৈরি হল, অপরদিকে তিন কোটি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার শেষ স্তরে উপনীত হল। সত্য কথা যে, বাংলার মানুষ শোষণ-উৎপীড়ন সহ্য করতে অভ্যন্ত; কিন্তু এমন ভয়াবহ শোষণ ও উৎপীড়ন তারা কোনোদিন দেখেনি।” (ঊংংধুং রহ খড়ৎফ ঈষরাব).
এদেশ দখলের পর এদেশের বুকে তাদের শাসন ও শোষণের পাকাপোক্ত ও কায়েমী করবার লক্ষ্যে বেনিয়া কোম্পানী প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা ধ্বসিয়ে দিল। পূর্ব থেকে চালু সমষ্টিগতভাবে গ্রাম্য সমাজের কাছ থেকে রাজস্ব আদয়ের প্রথা বাতিল করে চাষিদের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে রাজস্ব আদায়ের প্রথা চালু করল। মোগল আমল থেকে প্রচলিত উৎপন্ন ফসলের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ও বাতিল হলো। পরিবর্তে চালু করা হলো মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়। ফলে ব্যক্তিগতভাবে মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব পরিশোধের জন্য মুদ্রা সংগ্রহ করা অপরিহার্য হয়ে দেখা দিলো। আর সেই মুদ্রা সংগ্রহের প্রয়োজনে ফসল বিক্রি করা ছাড়া চাষির অন্য কোনো উপায় রইল না।
চাষির ফসল ক্রয় করার জন্য ইংরেজ বণিকেরা বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে ক্রয়কেন্দ্র খোলে। শুধু তাই নয়, বেশি মুনাফার আশায় এসব ক্রয়কৃত খাদ্যদ্রব্য গুমামজাত করা শুরু করল। পরে সুযোগ-সুবিধামতো এসব খাদ্যই চড়ামূল্যে সেই চাষিদের নিকট আবার বিক্রি করত। ফলে খাদ্য গুদামজাতকরণের মাধ্যমে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টির কারণেই এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে দুর্ভিক্ষ ঘনিয়ে এলো। ১৭৬৯ সালে ক্রয়কৃত সমস্ত ফসল ১৭৭০ সালেই আবর বেশি দামে বিক্রি হল। বাংলার চাষি তা ক্রয় করতে ব্যর্থ হয়ে নজিরবিহীন দুর্ভিক্ষের শিকার হলো। মারা গেল কয়েক লক্ষ আদম সন্তান। বাংলা ১১৭৬ সালের এই দুর্ভিক্ষই ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে ইতিহাস খ্যাত। ইংরেজ ঐতিহাসিক ‘ইয়ং হাজব্যান্ড’- এর ভাষায় :
“তাদের (ইংরেজ বণিকদের) মুনাফার পরবর্তী উপায় ছিল চাল কিনে গুদামজাত করে রাখা। তারা নিশ্চিত ছিল যে, জীবনধারণের পক্ষে অপরিহার্য এ দ্রবটির জন্য তারা যে মূল্যই চাইবে, তা পাবে।........ চাষিরা তাদের প্রাণপাত করা পরিশ্রমের ফল অপরের গুদামে মজুদ থাকতে দেখে চাষাবাস সম্বন্ধে এক রকম উদাসীন হয়ে পড়ল। ফলে দেখা দিলো ভয়ানক খাদ্যাভাব। দেশে যেসব খাদ্য ছিল, তা ইংরেজ বণিকদের দখলে। খাদ্যের পরিমাণ যত কমতে থাকল, ততই দাম বাড়তে লাগল। শ্রমজীবী দরিদ্র জনগণের চির দুঃখময় জীবনের ওপর পতিত হলো এই পুঞ্জিভূত দুর্যোগের প্রথম আঘাত। কিন্তু এটা এক অশ্রুতপূর্ব বিপর্যয়ের আরম্ভ মাত্র।’
“এই হতভাগ্য দেশে দুর্ভিক্ষ কোনো অজ্ঞাতপূর্ব ঘটনা নয়। কিন্তু দেশীয় জনশত্রুদের সহযোগিতায় একচেটিয়া শোষণের বর্বরসুলভ মনোবৃত্তির অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ যে অভূতপূর্ব বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখা দিলো, তা ভারতবাসীরাও আর কোনো দিন চোখে দেখেনি বা কানে শোনেনি। চরম খাদ্যাভাবের এক ভয়াবহ ইঙ্গিত নিয়ে দেখা দিলো ১৭৬৯ সাল। সঙ্গে বাংলা-বিহারের সমস্ত ইংরেজ বণিক তাদের সকল আমলা, গোমস্তা রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মচারী যে যেখানে নিযুক্ত ছিল সেখানেই দিবারাত্র অক্লান্ত পরিশ্রমে ধান-চাল কিনতে লাগল। এই জঘন্যতম ব্যবসায়ে মুনাফা এত শীঘ্র ও এত বিপুল পরিমাণে পেয়েছিল যে, মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে নিযুক্ত একজন কপর্দকশূন্য ভদ্রলোক এ ব্যবসায় করে দুর্ভিক্ষ শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রায় ৬০ হাজার পাউন্ড (দেড় লক্ষাধিক টাকা) দেশে পাঠিয়েছিল।’
ব্রিটিশ বেনিয়া রাজের সৃষ্ট ভয়াবহ এই দুর্ভিক্ষ কেবল বাংলাদেশের নয়-গোটা মানব জাতির ইতিহাসের একট কলংকিত অধ্যায়। মানব শিক্ষা ও সভ্যতার ইতিহাস থেকে বাংলার ভয়ঙ্কক এই দুর্ভিক্ষের তান্ডবলীলার কথা কোনদিন মুছবার নয়।
ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার এই দুর্ভিক্ষের বর্ণনা করে লিখেছেন:
“১৭৭০ সালের সারা গ্রীষ্মকালব্যাপী লোক মারা গিয়েছে। তাদের গরু-বাছুর, লাংগল-জোঁয়াল বেচে ফেলেছে এবং বীজধান খেয়ে ফেলেছে। অবশেষে তারা ছেলেমেয়ে বেচতে শুরু করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক সময় আর ক্রেতাও পাওয়া গেল না। তারপর তারা গাছের পাতা ও ঘাস খেতে শুরু করে এবং ১৭৭০ সালের জুন মাসে দরবারের রেসিডেন্ট স্বীকার করেন যে, জাতির মানুষ মরা মানুষের গোশ্ত খেতে শুরু করে। অনশনে শীর্ণ, রোগে ক্লিষ্ট, কঙ্কালসার মানুষ দিনরাত সারি বেঁধে বড় বড় শহরে এসে জমা হতো। বছরের গোড়াতেই সংক্রামক রোগ শুরু হয়েছিল। মার্চ মাসে মুর্শিদাবাদে পানি বসন্ত দেখা দেয় এবং বহুলোক এই রোগে মারা যায়। শাহজাদা সাইফুতও এই রোগে মারা যান। মৃত ও মরণাপন্ন রোগী স্তূপাকারে পড়ে থাকায় রাস্তাঘাটে চলাচল করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। লাশের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, তা পুঁতে ফেলার কাজও দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। প্রাচ্যের মেথর, কুকুর, শিয়াল ও শকুনের পক্ষেও্র এত বেশি লাশ নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব ছিল না। ফলে দুর্গন্ধযুক্ত গলিত লাশ মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছিল।” (পল্লী বাংলার ইতিহাস; সুপ্রকাশ রায়)।
হান্টারের লেখায় আরও জানা যায় যে, সরকারি হিসেবে ১৭৭০ সালের মে মাস শেষ হওয়ার আগেই জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ শেষ হয়ে গিয়েছিল। জুন মাসের প্রতি ষোলজনের ৬ জন মারা গিয়েছিল। শেষাবধি জমিতে আবাদ করার মত পর্যাপ্ত লোকও আর অবশিষ্ট ছিল না।
এত বেশি রায়ত মারা গিয়েছিল এবং জমি পরিত্যাগ করেছিল যে, তাদের পক্ষে বকেয়া খাজনা আদায় করার সম্ভাবনা তিরোহিত হয়েছিল।
“কোম্পানি সরকারের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা তবুও মেটেনি, শোষণ-পীড়ন গতিতেই। শকুনের মতো লাশের ওপর বসেও কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিল মৃতপ্রায় চাষিদের ওপর। তাই দেখা যায়, দুর্ভিক্ষের পূর্বে (১৭৬৮) যেখানে বাংলাদেশের রাজস্ব, ১,৫২,০৪,৮৫৬ টাকা, দুর্ভিক্ষের পর ১৭৭১ সালে সমগ্র দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক মরে যাওয়ার পরও মোট রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াল ১,৫৭,২৬,৫৭৬ টাকায়।” (পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ ও নীল বিদ্রোহ পৃ. ০৯-১১)
এ তো গেল কৃষি ও কৃষির ওপর নির্ভরশীল কৃষকদের দুরবস্থার কথা। এবার আসুন, আমরা পলাশী যুদ্ধোত্তর আমাদের শিল্পী ও কারিগরদের অবস্থার দিকে তাকাই : ব্রিটিশ বেনিয়া রাজ এদেশে শিল্প-পণ্যের ওপর কি পরিবর্তন চাপিয়ে দিয়েছিল এবং তার ফল কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এর আগে এদেশের গ্রামীন অর্থ-ব্যবস্থা ছিল কৃষি ও শিল্প পেশানির্ভর। তাঁত এবং চরকাই ছিল একমাত্র অর্থকরী শিল্পের মূল ভিত্তি। বেনিয়া শাসক ও শোষকেরা সেখানেও ছোবল হানল। তাঁত ভেঙে ছারখার করল, চরকা করল ধ্বংস। যে দেশের শিল্প-পণ্য সম্ভার দিয়ে ইংল্যান্ডে ব্যবসায় চলত, ইউরোপের কোনো দেশের পণ্য সম্ভার এদেশের বাজারে বিক্রি করার কথা যখন কেউ কল্পনাও করেনি- বাংলাদেশের তথা উপমমহাদেশের বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার কল্পনাও যখন ইউরোপ করেনি; পলাশী যুদ্ধ সেই ইউরোপের ভাগ্য ফিরিয়ে দিলো। ব্রুক এডামস-এর ভাষায় : ১৭৫০ সালে যখন বার্ক ইংল্যান্ডে আসেন, তখন সমগ্র প্রদেশে বারটার বেশি ব্যাংক ছিল না। অথচ ১৭৯০ সালে শহরের প্রত্যেকটি বাজারেই ব্যাংক ছিল। বাংলাদেশ থেকে রৌপ্য আসার পর শুধু অর্থের প্রচলন বেড়ে যায়নি, (ব্যাংক) আন্দোলনও জোরদার হয়েছে। কারণ হঠাৎ দেখা গেল, ১৭৫৯ সালে ব্যাংক ১০ পাউন্ড ও ১৫ পাউন্ডের নোট বাজারে ছেড়েছে।
শিল্প বিপ্লবের পূর্বকার ইংল্যান্ডের অবস্থার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ব্রæক এডামস অন্যত্র বলেছেন :
“পলাশী যুদ্ধের পর থেকেই বাংলাদেশের লুণ্ঠিত ধন-রতœ ইংল্যান্ডে আসতে লাগল এবং তখনই এর চাক্ষুস ফল বোঝা গেল। পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিল ১৭৫৭ সালে। তারপর থেকে (ইংল্যান্ডে) যে পরিবর্তন আরম্ভ হয়েছিল তার তুলনা বোধহয় ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যাবে না। ১৭৬০ সালে আগে ল্যাংকাশায়ারে বস্ত্র-শিল্পের যন্ত্রপাতি এদেশের মতোই সহজ-সাধারণ ছিল এবং ১৭১০ সালে ইংলন্ডে লৌহ শিল্পের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়।..... .ইংল্যান্ডে ভারতের ধন-সম্পদ পৌঁছার এবং ঋণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগে পর্যন্ত প্রয়োজন অনুরূপ শক্তি (মূলধন) ইংলন্ডের ছিল না।” (পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ : পৃ. ৫৫-৫৬)
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বস্ত্র ও অন্যান্য পণ্যের মুকাবিলায় টিকাতে না পেরে যেখানে ব্রিটিশ বস্ত্র-শিল্পের মালিকরা তাঁতের অনুন্নত বস্ত্র-শিল্প বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে আন্দোলন শুরু করে, সেখানে ১৭৬০ সালের পর দেখা দিল বিস্ময়কর পরিবর্তন।’ ৬০ সালে এল তাঁতের উড়ন্ত মাকু, ’ ৬৪ ও ’৭৬ সলে তৈরি হল সুতা কাটার যন্ত্র ‘জেনি’ ও ‘সিউল’। ‘৬৮ সালে আবিষ্কৃত হল বাষ্পীয় যন্ত্র। এসব আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত হল ভারতবর্ষের অফুরন্ত লুণ্ঠিত সম্পদ। ফলে অঢেল অর্থ আর বাষ্পীয় শক্তির যৌথ সহযোগে অসম্ভব সম্ভব হলো। ইংল্যান্ডের বস্ত্র-শিল্পের মান ও পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের বাজারে এদেশের বস্ত্র-শিল্পের চাহিদা কেবল কমেই গেল না-অধিকন্তু তাদের উদ্ধৃত্ত কাপড় এদেশে রফতানি করবারও প্রয়োজন বোধ করল ইংলন্ডের বস্ত্র-শিল্প মালিকরা। এরপরও দেশীয় বস্ত্র-শিল্পের চাহিদাকে শূণের কোটায় নামিয়ে আনার এবং সেই সংগে বিলেতী বস্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলার স্বার্থে বেনিয়া শোষক গোষ্ঠী দেশী পণ্যের উপর ট্যাক্সের গুরুভার চাপিয়ে দিল। কিন্তু তদ্সত্তে¡ও দেশী পণ্যের মুকাবেলায় টিকতে না পেরে অবশেষে বস্ত্রের ওপর ৭০-৮০ ভাগ শুল্ক চাপিয়ে দিলো আর বিলেতী মালের ওপর থেকে শুল্ক উঠিয়ে নিলো। ফলে দেশীয় শিল্প আত্মরক্ষায় ব্যর্থ হয়ে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে গেল। একই অবস্থা হলো অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রেও। অতএব এসব শিল্প ধ্বংস হবার সংগে শিল্পের সংগে জড়িত বিরাট শ্রম ও জনশক্তি গেল ধ্বংস হয়ে। দৈনিক অত্যাচার ও অর্থনৈতিক দরবস্থায় পড় তাঁতীরা তাঁত ছেড়ে দিল। পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে তাঁতীদের সংগে অন্যান্য শিল্পের লোকেরাও কৃষির দিকে হাত বাড়াল শেষ সম্বল হিসেবে। অথচ সেখানেও যে তাদের জন্য কোন আশ্বাস ছিল না- তা পূর্বেই বলা হয়েছে।
ব্রিটিশ বেনিয়া শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর নির্মম শাসন ও শোষণেল যাঁতাকালে পিষ্ট হয়ে এদেশের কৃষক, তাঁতী, মজুরসহ সর্বশ্রেণীর মানষের বাঁচার নূনতম পথও আর খোলা রইল না। কেবল তখনই দুটো পথ তাদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিল। এক, শোষণ-নির্যাতনের চাপে তিল তিল করে অনিবার্য ধ্বংসে পরিণত হওয়া। দুই. বাঁচার শেষ চেষ্টায় বিদ্রোহের মাঝে মরণ আঘাত দেওয়া, বিপ্লবের মাধ্যমে শোষক বেনিয়া গোষ্ঠীর উচ্ছেদ সাধন করে আজাদী ও মুক্তির স্বর্ণোজ্জ্বল প্রভাব ছিনিয়ে আনা। বাংলা বিহারের মানুষ দ্বিতীয় পথকেই বেছে নিল। শোষণ-নিষ্পেষণে অতিষ্ঠ ও মরণোন্মুখ এদেশের শ্রমজীবী মানুষ, চিরকালের নিরীহ মানুষ মুখ বুঁজে মার খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করে হয়ে উঠল বিদ্রোহ ও প্রতিবাদমুখর। যে হাত ছিল একদিন লাঙলের মুঠোয়, যে হাত সৃষ্টি করত বিখ্যাত মসলিন, সে হাত উঠিয়ে নিলো সুতীক্ষè অস্ত্র। শত্রুকে ক্ষমা না করার এবং ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’র নীতি গ্রহণ করল সে হাত শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জয় ধ্বজা উড়িয়ে যিনি সর্বপ্রথম মজলুম মানুষের মুক্তি মিছিলের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসলেন- তিনিই ইতিহাস খ্যাত ফকীর মজুন শাহ। আমাদের আযাদী সংগ্রামের সর্বপ্রথম সৈনিক। ফকীর মজনু শাহ বর্তমান ভারতের গোয়ালিয়র রাজ্যের নেওয়াত এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাদরী-বেরিহানা তরিকার ফকীর বা দরবেশ ছিলেন। এই তরিকার ফকীরদের সম্পর্কে মরহুম নওয়াবজাদা আবদুল আলী বলেন : “তারা মাথায় লম্বা চুল রাখে, রঙিন কাপড় পরে এবং লোহার শিকল ও লম্ব চিমটা ব্যবহার করে। প্রধানত আতপ চাল, ঘি ও নুনই তাদের খাদ্য। তারা মাছ- গোশ্ত খায় না এবং কিছুকাল আগেও তারা কৌমার্যব্রত পালন করত। সফরের সময় তারা মৎস্যশোভিত পতাকা বহন করে এবং বিরাট দলবল নিয়েই তারা চলাফেরা করে। তাদের উপাধি ‘বোরহানা’ এসব ফকীর ‘বসরিয়া’ তরিকার ‘তৈফুরিয়া খানেওয়াড়ো’ ও ‘তাবাগাতি’ ঘরের অন্তর্ভুক্ত।............শাহ মাদার হচ্ছেল এ তরীকার প্রবর্তন।” (বাঙলার ফকীর বিদ্রোহ : পৃ. ৬)
১৬৫৯ সালে বাংলার তদানীন্তন সুবেদার শাহ সুজা বোরাহানা ফকীর শাহ সুলতান হাসান মুরিয়া বোরহানাকে এক সনদ দান করেন। উক্ত সনদবলে বোরহানা ফকীরগণ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার যে কোনো স্থানে যাতায়াতে তাদের পতাকা, বাদ্যযন্ত্র, অন্যান্য জিনিসপত্র বহনের অধিকার লাভ করে। সনদে মালিকবিহীন ভূ-সম্পত্তি ভোগ দখলের অধিকারও তাদের দান করা হয়। অধিকন্তু তারা যেখানেই যাক, সেখনাকার জমিদার কিংবা প্রজা তাদের খাওয়া খরচ বহন করবে এবং তাদের কোনোরূপ কর দিতে হবে না বলেও উক্ত সনদে উল্লেখ করা হয়।
এরা এক সময় দল বেঁধে ভারতবর্ষের নানা স্থানে বসবাস ও ইতস্তত ঘোরাফেরা করে আসলেও কালক্রমে এরা দেশের নানা স্থানে পতিত ও খাস জমি দখল করে কিংবা মুসলিম শাসকদের থেকে ‘দান’ প্রাপ্ত জমিতে চাষাবাদ শুরু করে। কালক্রমে স্থায়ী কৃষকে পরিণত হলেও পোশাক-আশাকে এরা কিন্তু নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। ব্রিটিশ বেনিয়া শাসন হঠাৎ করেই এদের যাতায়াতের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে (দ্র. পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ ও নীল বিদ্রোহ, পৃ. ৮৫-৮৬)। এমনকি তীর্থ ক্ষেত্র ভ্রমণের উদ্দেশ্য যাতায়াতকারী ফকীরদের উপরও বিরাট কর ধার্য করে। যে জমি তারা নিষ্কর ভোগ করত,তার উপরও অতিরিক্ত কর প্রয়োগ করা হল। ফলে একদিকে জীবিকা, অপরদিকে ধর্মীয় অধিকারের উপর এই বাধা-নিষেধ তাদেরকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। আর এই ক্ষোভই তাদরকে বিদ্রোহের পেছনে মদদ যোগায়। অতএব জীবিকার স্বাভাবিক তাগিদে একদিকে খাদ্যশস্য গুমামজাতকারী মহাজন ও কুঠিয়ালদের উপর তারা আক্রমণ চলাতে শুরু করে এবং অধিক মুনাফার আশায় মজুদ করা খাদ্য লুট করতে শুরু করে, অপরদিকে এই জালিম শাসক ও শোষকদের সহযোগী যেকোন লোকদের তারা আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত করতে থাকে।
১৭৬৩ সালে ফকীর বাহিনী সর্বপ্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা কুঠির আক্রমণ করে। সে সময় ঢাকা কুঠির ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী মি. র‌্যালফ লিসেস্টার নামক জনৈক শ্বেতাঙ্গ ফকীর বাহিনীর আগমনে ভীত হয়ে কোনোরূপ প্রতিরোধের চেষ্টা না করেই বুড়িগঙ্গার বুকে আশ্রয় নেন। ফলে বিনা বাধায় ফকীরদের লুণ্ঠন ক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। কোম্পানির তৎকালীন গভর্নর কুখ্যাত লর্ড ক্লাইভ মি. র‌্যাফল লিসেস্টারকে কাপুরুষ আখ্যা দিয়ে ফকীরদের ‘ছোট লোকের দল’ হিসেবে অভিহিত করে।
ঢাকা কুঠির থেকেই ফকীর বাহিনীকে অব্যাহত অগ্রাভিযানে লিপ্ত দেখা যায়। এসব অভিযানের সবগুলোকেই লক্ষ্যস্থল হিসেবে দেখা যায় কোম্পানি কুঠি এবং তাদের খাজনা আদায়কারী অত্যাচারী পাষন্ড জমিদারদের কাছারিগুলো। অনেক সময় তারা জমিদারদের নিজস্ব বসতবাটি এবং সুদখোর-মহাজন ও দালাল-ফড়িয়াদের বাড়িতেও আক্রমণ চালিয়েছে। আক্রমণ অভিযানগুলোর অধিকাংশই যে দলপতি ফকীর মজনু শাহ্র নেতৃত্বে পরিচালিত হতো- এ ব্যাপারে সকল বর্ণনাই একমত এবং আরও একমত যে, মুসা শাহ্, পরাগল শাহ্, চেরাগ আলী শাহ্, সোবহান শাহ্, করিম শাহ্ প্রমুখ এক্ষেত্রে ফকীর মজনু শাহ্র বিশিষ্ট শাগরেদ ও সহচর ছিলেন। মূসা শাহ্ ছিলেন তাঁর জ্ঞাতিভ্রাতা এবং দক্ষিণ হস্তস্বরূপ। প্রধানত তাঁর সঙ্গে পরামর্শক্রমেই তিনি অভিযানের সকল পরিকল্পনা তৈরি করতেন। অধিকন্তু এই মুসা শাহ্ই ফকীর মজনু শাহ্র মৃত্যু-পরবর্তী বহু বছর ফকীর বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে এ আন্দোলনে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন।
মজনু শাহ্ ভারতের কানপুর থেকে চল্লিশ মাইল দূরে মকানপুর নামক শাহ্ মাদারের দরগায় বাস করতেন। এখান থেকেই তিনি প্রতি বছর সহস্রাধিক অনুচরসহ বেনিয়া কোম্পানির অধিকারভুক্ত বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করতেন। বিহারের পূর্নিয়া, কুচবিহার, বাংলার রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, জলপাইগুড়ি, মালদহ, পাবনা ও ময়মনসিংহ জেলায় অধিকাংশ সময়ে এবং ঢাকা ও সিলেট জেলায় মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করতেন তারা। এসব অভিযানে ফকীরদের সঙ্গে উট, ঘোড়া, হাউই, গাদা-বন্দুক, বর্শা, কয়েকটি ঘূর্ণায়মান কামান থাকত। এই ঘূর্ণায়মান কামানটিকে ‘ভেলা’ বলা হতো। এর সঙ্গে একটা চক্র যুক্ত ছিল এবং চক্রটি ঘূর্ণনের ফলে চতুর্দিকে অজ¯্র ধারায় অগ্নিবর্ষিত হতো। হয়তো এ জন্যই লোকে একে ‘ঘূর্ণায়মান কামান’ বলে জানত।
ফকীর মজনু শাহ্ পরিচালিত অভিযানগুলোর ভেতর আমরা ১৭৬৩ সালের ঢাকা কুঠি আক্রমণ ছাড়া, পরবর্তী কয়েক বছর অন্য কোনো আক্রমণ অভিযানের সংবাদ অবগত নই। ১৭৬৯ সালে ফকীর বাহিনীর বিরুদ্ধে লে. কীথের নেতৃত্বাধীনে একটি সেনাদল প্রেরিত হয়। পূর্নিয়ার উত্তরে বোরাং অঞ্চলে ফকীর দলের সঙ্গে সংঘর্ষে কীথ নিহত হন। এবং অন্যরাও মারা যান। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুরে ফকীরদের বিরুদ্ধে ১০ জন সিপাই ও ১০০ বরকন্দাজের সমস্বয়ে একটি কোম্পানি পাঠানো হয়। ফকীরদের সংখ্যাধিক্যে তারা ভয় পেয়ে ফিরে আসে। পরের বছর ১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাবনার বেলকুচি ও লক্ষীনামপুর নামক স্থানে ফকীরদের আগমন ঘটেছিল বলে ক্যাপ্টেন রেনেল মুুর্শিদাবাদ কর্র্তৃপক্ষকে জানান। পরে তারা সেখানে থেকে ময়মনসিংহ জেলার পুখরিয়া পরগনাার দিকে গেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। ক্যাপ্টেনের চিঠি পেয়ে লে. টেইলরের নেতৃত্বে দু’দল সিপাই পাঠানো হয়। তার সঙ্গে লে. ফেলথামের নেতৃত্বে আর দুটো দল ফকীরদের পথরোধ করার জন্য ঘোড়াঘাট (রংপুর) পাঠানো হয়। গোবিন্দগঞ্জ (রংপুর) থেকে ১২ মাইল দূরে কাজীপাড়া নামক স্থানে ফকীর বাহিনী ফেলথাম বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়। ফকীর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাদের নেতা মজনু শাহ বগুড়ার মস্তানগড়ের দিকে পালিয়ে যান। পরে দলবল সেখানে তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়। মস্তানগড়ে তিনি একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ দেখা যায়।

Monday, March 4, 2019

মুক্তিযুদ্ধোত্তর জাতীয় সংহতির চেষ্টা ও বিভেদের প্রয়াস - আবুল আসাদ

    

        মুক্তিযুদ্ধোত্তর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার এক পর্যায়ে জাতীয় সংহতি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার শক্তিশালী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা উপলক্ষে ‘বাঙালীরা ক্ষমা করতে জানে’-কথা দিয়েই তার এই উদ্যোগের যাত্রা শুরু।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, সেটা মানব ইতিহাসের চলমান সংস্কৃতির একটা অংশ। আজকের আধুনিক বিশ্ব যাকে বলা হয়, সেখানেও রয়েছে এর উজ্জ্বল অনেক দৃষ্টান্ত। ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক অন্যায় যুদ্ধে হাজার হাজার ভিয়েতনামীকেই শুধু হত্যা করা হয়নি, বর্বর বোমা বর্ষণে হাজারো জনপদ, ফসলের মাঠ, বিলিয়ন বিলিয়ন টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের গলাগলি ধরার ক্ষেত্রে ক্ষমা চাওয়ার দাবী বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সবচেয়ে বড় আত্মঘাতি ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর দক্ষিণের মধ্যে এই গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়, অন্য অর্থে বলা যায় এই গৃহযুদ্ধ হয় ঐক্যপন্থী ও বিভেদ পন্থীদের মধ্যে। এই যুদ্ধে ৬ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। আহত হওয়ার সংখ্যা ৪ লাখ ৭৬ হাজার। এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐক্যপন্থীরা বিজয়ী হয়, পরাজিত হয় দক্ষিণের বিচ্ছিন্নতাবাদিরা। যুদ্ধকালে যত রক্তই ঝরুক, দক্ষিণের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যে দিন যুদ্ধ শেষ হয়, তারপর আর এক ফোটাও রক্ত ঝরেনি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে, বিচার তো দূরে, ফাঁসি তো আরও দূরে, কেউ অভিযুক্তই হয়নি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ঘোষণা করেন, “To get the deluded men of the rebel armies disarmed and back to their homes ......... Let them once surrender and reach their homes, they wan’t take arms again.... Let them all go, officers and all, I want submission, and no more bloodshed.... I want no one punished, treat them liberally all around” যার সারকথা হলো: বিদ্রোহী সৈনিক যারা অস্ত্র ত্যাগ করবে, আত্মসমর্পণ করবে এবং বাড়িতে ফিরে যাবে, আর অস্ত্র হাতে নেবে না, তাদের অফিসারসহ সকলকে ছেড়ে দাও। আমি আনুগত্য চাই, আর কোনো রক্তপাত চাই না। চাই না কেউ শাস্তি পাক। সর্বত্র সকলকে উদারভাবে দেখতে হবে।’ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের এ ঘোষণা অক্ষরে প্রতিপালিত হয়েছে। ঐক্যপন্থী বিভেদপন্থী সকলেই যুদ্ধের পর একে অপরের গলা জড়িয়ে ধরেছে। আজও গলা জড়িয়ে ধরেই রয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে তা হয়নি। স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান বাহিনীর যুদ্ধ অপরাধীদের ছেড়ে দিলেও, যাদের যুদ্ধ অপরাধী কিংবা মানবতা বিরোধী অপরাধীর তালিকায় নাম ছিল না, তাদের জন্যে নতুন আইন করে, নতুন ট্রাইবুন্যাল করে, বিচারের কাঠ গড়ায় তুলে ফাঁসি পর্যন্ত দেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৫ দশক পর। কেউ কেউ অবশ্য বলেন এই বিচারে বাইরের হাত রয়েছে। সেই ‘বাহির’টা যদি ভারত হয়, তাহলে ব্যাপারটা বিস্ময়কর হয়ে দাড়ায়। কারণ ভারতের কারণেই বা ভারত চেয়েছিল বলেই ১৯২ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী সৈন্যের বিচার বাংলাদেশ করতে পারেনি বিচারের জন্যে আইন তৈরি ও ট্রাইবুন্যাল গঠন করা সত্ত্বেও। ভারত তার স্বার্থেই তখন ওটা করেছিল। কারণ ভারত চায়নি যে, পাকিস্তানী সৈন্যের ১৯২ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হোক। এর পিছনে রহস্য ছিল, সিমলা চুক্তি (২ জুলাই ১৯৭২) এবং দিল্লী এগ্রিমেন্ট (২৮ আগস্ট ১৯৭৩) অনুসারে ভারত ও পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশে ধৃত পরে ভারতে আশ্রয়ে যাওয়া পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীরাও শামিল ছিল। এর বড় প্রমাণ হলো, দিল্লী এগ্রিমেন্ট ধারা-৩ এর ৩ ও ৫ উপধারায় যেখানে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে আটকে পড়া মানুষ বিনিময়ের কথা আছে। সেখানে যুদ্ধবন্দীর উল্লেখ নেই। পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের উল্লেখ আছে ধারা-৩ এর উপধারা ১ এবং ২-এ, কিন্তু এই বিনিময় সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের ভূমিকার কোন উল্লেখ নেই। অন্যদিকে উপধারা ৬-এ ভারত-প্রতিশ্রুত পাকিস্তানী বন্দী বিনিময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর বিচার না করার বাংলাদেশের সম্মতির কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এ সম্মতি বাংলাদেশ কখন দিল সে কথার কোন উল্লেখ নেই। উল্লেখ্য, দিল্লী এগ্রিমেন্টটি সিমলা চুক্তির মতই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর পরিষ্কার অর্থ হলো, বাংলাদেশের মতামতের তোয়াক্কা না করেই ভারত পাকিস্তানের সাথে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের চুক্তি করেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে এইভাবে ভারতের ইচ্ছাটি প্রধান নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে।
শেখ মুজিব সরকার ভারতীয় চাপে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীসহ ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবার পর স্বাভাবিকভাবেই দেশীয় কলাবরেটরদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য স্বাধীনতা উত্তর শেখ মুজিবের সরকার কিন্তু হঠাৎ করেই কলাবরেটরদের ক্ষমা ঘোষণা করেননি। কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী ও যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সৈন্যদেরই যখন অবস্থার কারণে বা অবস্থার প্রয়োজনে নিঃশর্তে ছেড়ে দিতে হলো, তখন ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দেশের যারা পাকিস্তানী সৈন্যের সহায়তা করেছেন বা তাদের সহযোগী হয়েছেন, তাদের শাস্তি দেয়ার যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি বলেই বাংলাদেশের তদানীন্তন সরকার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কলাবরেটরদের সাধারণ ক্ষমা করেন। ঘটনা কিন্তু মাত্র এটুকুই নয়। কলাবরেটরদের ক্ষমা ঘোষণা মাত্র এ ধরনের কোন চিন্তা থেকে হয়নি। সাধারণ দাবি ও সাধারণ জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা হয়। ১৯৭২ সালের মার্চ থেকেই আবুল মনসুর আহমদ, আবুল ফজলের মত দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে কলাবরেটরদের ছেড়ে দেবার আবেদন ও দাবি উত্থিত হতে থাকে। এককালীন আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী একজন সর্বজনমান্য নেতা জনাব আতাউর  রহমান খান এই সময় এক বিবৃতিতে বলেন, “জাতি পুনর্গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সমাধা না করে সরকার সারা দেশে দালাল ও কল্পিত শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় রত আছেন। মনে হচ্ছে, এটাই যেন সরকারের সব চাইতে প্রধান কর্তব্য। যারা ভিন্ন রাজনৈতিক মত পোষণ করতেন, অথচ খুন, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ, কিংবা লুটপাটের মতো জঘন্য কার্যে প্রবৃত্ত হননি, তাদের উপর গুরুতর শাস্তি আরোপের মাধ্যমে দেশের কোন উপকার হবে না। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগে যারা বেপরোয়াভাবে বাংলাদেশ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের অনেকে সরকারের উচ্চপদে আসীন হয়েছেন, অথচ মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন থাকা সত্ত্বেও যারা পাক বাহিনীকে সমর্থন দান করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে কিংবা শরণার্থী হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। এই আইন জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলেছে এবং এই আইনের মাধ্যমে বিচার একটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ বিচার ও সকল বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুপারিশ করছি।”
এই ধরনের বিভিন্ন বিবৃতি ও দাবির প্রেক্ষিতে এবং দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর শেখ মুজিবের সরকার সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে নিম্নোক্ত ‘প্রেস নোট’ প্রচার করেন :
“সরকার ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশে (১৯৭২) সালের রাষ্ট্রপতির ৮ নং আদেশ মোতাবেক অপরাধের দায়ে দণ্ডিত অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষমা প্রদর্শনের প্রশ্নটি পুনরায় বিবেচনার পর ঘোষণা করিতেছেন :
১. এই আদেশের ২ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত (ক) উক্ত আদেশ মোতাবেক যে কোন অপরাধের দায়ে দণ্ডিত ব্যক্তিদের দণ্ড ১৮৮৮ সালের ফৌজদারী দণ্ডবিধির ৪০১ ধারা মোতাবেক মওকুফ করা হইল এবং উক্ত আদেশ ব্যতীত অপর কোন আইন বলে বিচার্য ও শাস্তিযোগ্য কোন অপরাধের সহিত জড়িত থাকার জন্য গ্রেফতারী পরওয়ানা না থাকিলে সেইসব ব্যক্তিকে কারাগার হইতে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হইবে। (খ) উক্ত আদেশ বলে যে সকল ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট অথবা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা বিচারাধীন রহিয়াছে উল্লিখিত ম্যাজিস্ট্রেট অথবা ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে সে সব প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং এই আদেশ ব্যতীত অপর কোন আইনে বিচার্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধের হুলিয়া না থাকিলে তাদেরকে সরকারি হেফাজত হইতে মুক্তি প্রদান করিতে হইবে। (গ) এই আদেশ বলে বিচার্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধের দায়ে যে সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হইয়াছে অথবা তদন্ত চলিতেছে সেই সব মামলা ও তদন্ত কার্য বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে এবং সব গ্রেফতারী পরওয়ানা অথবা আদালতের হাজির হওয়ার নির্দেশ এবং এই আদেশ বলে কোন ব্যক্তির ব্যাপারে তাহার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ থাকিলে ইহা বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে এবং অপর কোন আইনে বিচার্য ও শাস্তিযোগ্য না হইলে তাহাদেরকে সরকারি হেফাজত হইতে মুক্তি প্রদান করিতে হইবে; তবে কোন ব্যক্তি অনুপস্থিতিতে দণ্ডিত হইয়া থাকিলে অথবা কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা থাকিলে তাদের ক্ষেত্রে উপযুক্ত আদালতে হাজির হইয়া ক্ষমা ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর থাকিবে।
২. এই আদেশ বলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা (হত্যা), ৩০৪ ধারা (হত্যার চেষ্টা কিন্তু হত্যার শামিল নয়), ৩৬৭ ধারা (ধর্ষণ), ৪৩৫ ধারা (অগ্নিসংযোগ অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য দ্বারা অপকর্ম সাধন), ৪৩৬ ধারা (ঘরবাড়ি ধ্বংসের অভিপ্রায়ে অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য দ্বারা অপকর্ম সাধন) এবং ৪৩৮ ধারা (জাহাজে অগ্নিসংযোগ অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য দ্বারা অপকর্ম সাধন) মোতাবেক অভিযুক্ত ও দ-িত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ১ নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হইবে না।
মুজিব সরকারের এই ক্ষমা ঘোষণা সর্বমহল থেকে অভিনন্দিত হয়। মুজিব সরকারের প্রবল বিরোধী এবং বাম আন্দোলনের গুরু বলে পরিচিত, ভাসানী ন্যাপের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তার এবং দলের সম্পাদক মণ্ডলীর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ন্যাপ বহু আগে থেকেই নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তি দাবি করে আসছে।’ বিবৃতিতে বাংলাদেশ দালাল আইন সংক্রান্ত আইনের ৮ নং ও ৫০ নং ধারা বাতিল করার দাবি জানান। তিনি ১৫ ডিসেম্বর আরেক বিবৃতিতে বলেন, ‘ক্ষমা চাই, সমানাধিকার চাই। রাষ্ট্রপতি আদেশের ৫০ ও ৮ ধারা বাতিল চাই।’ বাংলাদেশ  জাতীয় লীগের সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান তার বিবৃতিতে বলেন, ‘আরো আগেই দেশের স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। এর ফলে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে এবং মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করে বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেবেন।’ দেশের প্রবীণ রাজনীতিক ও চিন্তাবিদ জনাব আবুল হাশিম প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারকে অভিনন্দিত করে বলেন, ‘জনগণের ভাগ্যকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্যে সরকার সঠিক পন্থাই বেছে নিয়েছেন। গণতন্ত্রের এ উদ্যম বজায় থাকলে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা রয়েছে।’ সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা এবং স্বনামধন্য কলামিস্ট ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ (স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের পিতা) বলেন, ‘আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় সরকার যখন একবার অনুকম্পার দরজা খুলিয়াছেন, ষোল হাজারের মতো বন্দীকে মাফ করিয়া দিয়েছেন, তখন বাকী সবার ক্ষেত্রেও তেমনি উদারতা প্রদর্শন করুন। অন্যথায় দুই বছর পরে আজ  যেমন চারশ লোককে প্রমাণের অভাবে মুক্তি দিতে হলো, বার বছর পর (৩৭ হাজার দালালদের বিচারে ১২ বছর লাগবে) মানে গ্রেফতারের সময় হতে ১৪ বছর পর আরো অনেক লোককে তেমনি মুক্তি দিতে হইতে পারে।’ (ইত্তেফাক, ২ নভেম্বর, ১৯৭৩)। তদানীন্তন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ শেখ মুজিব সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করে বিবৃতি দেয়।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মত ১৯৭৬ সালে কলাবরেটর আইনের বাতিলও ছিল অবস্থার একটা স্বাভাবিক পরিণতি। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছিল ১ লাখ লোককে এবং ৩৭৪৭১ জন দালালকে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের বিচারের জন্য ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এই ৭৩টি ট্রাইব্যুনালে ২২ মাসে ২৮৪৮টি মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হয়। এদের মধ্যে দণ্ডিত হয় মাত্র ৭৫২ জন, তাও প্রায় সব ক্ষেত্রেই ছোট খাটো অপরাধের জন্য। অবশিষ্ট ২০৬ জন খালাস পেয়ে যান। এই পটভূমিতে ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হয়। সাধারণ ক্ষমার অধীনে ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছাড়া পেয়ে যায় ৩০ হাজার বন্দী। এখানে উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের বিভিন্ন অপরাধ ও অভিয়োগে স্বাধীনতা উত্তরকালের যাদের বন্দী রাখা হয়, বিচার করা হয়, শাস্তি দেয়া হয়, তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী নাম করার মতো কেউ ছিলনা। তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা অভিয়োগ দায়ের করা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ দশকের মাথায় জামায়াত নেতৃবৃন্দের অপরাধ খুঁজে পাওয়া কোনো যুক্তিতেই আসে না।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলেও হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ এই চার অপরাধের  বিচার, গ্রেফতার ও শাস্তি বিধানের আইনী বিধান বহাল রাখা হয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার ১৯৭৬ সালের দালাল আইন বাতিল হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ দুই বছর এক মাস সময়ে উক্ত চার অপরাধের অভিযোগে একটিও মামলা দায়ের হয়নি। এই অবস্থার পটভূমিতেই ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে দালাল আইন বাতিল হয়ে যায়।
এখানে একটা বড় প্রশ্ন হলো ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর হতে ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে কোন মামলা দায়ের হলো না কেন? এর একটি জবাব হলো ঐ চারটি অপরাধের ক্ষেত্রে দায়েরযোগ্য কারও কোনো অভিযোগ ছিল না। এই জবাবটি অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তব নয়। কারণ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংঘাতে দায়েরযোগ্য ঐ ধরনের কোন অপরাধ একেবারেই ছিল না তা হতে পারে না। অন্য আরেকটি জবাব এই হতে পারে যে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিও ছিল, অপরাধও ছিল কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংক্ষুব্ধরা অভিযোগ বা মামলা দায়েরে আগ্রহী হয়নি। এটাই অনেক ক্ষেত্রের বাস্তবতা বলে ধরে নেয়া যায়। কেন আগ্রহী হয়নি? কেন সংক্ষুব্ধ মানুষ অপরাধীর শাস্তি বিধানের জন্য মামলা দায়েরে এগিয়ে যায়নি? খুব বড় একটা প্রশ্ন এটা। এক কথায় এর কোন জবাব মিলবে না। এই প্রশ্নের জবাব প্রকৃতপক্ষে সন্ধান করতে হবে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো এবং বাংলাদেশের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমন্বয় চিন্তার মধ্যে। এই ক্ষেত্রে এই সময়ের সুন্দর একটা সমাজ বিশ্লেষণ দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক ড. তারেক মুহাম্মদ তওফীকুর রহমান তার “বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজ : ভূমিকা ও প্রভাব (১৯৭২-২০০১)” শীর্ষক গ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর অবস্থার উত্তাপ ঠাণ্ডা হয়ে আসার সাথে সাথে দালাল আইনে ধৃত এবং বিচারের সম্মুখীন ব্যক্তিদের বিচার সংক্রান্ত বিষয়টি সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও জটিলতার সৃষ্টি করে চলছিল অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে-এই সামাজিক চিত্রটি এক কথায় সামনে আনার পর তিনি লিখেছেন :
“আপাত: পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও শত্রুতার নেপথ্যে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ হলো ‘কমপ্যাক্ট সোসাইটি।’ আবহমান কাল থেকে শাশ্বত গ্রাম্য সালিশ বিচার ব্যবস্থার প্রচলনে গ্রামীণ সমাজে যে ভারসাম্য বর্তমান ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় তা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তা নতুন আঙ্গিকে ও নেতৃত্বে স্থিতিশীল হয়ে আসতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তেজনা কেটে যেতে থাকে এবং মুক্তিযোদ্ধাগণও সমাজের রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে থাকেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তীতে উত্তেজনা প্রশমনে রক্তের বন্ধন, আত্মীয় সূত্রতা এবং সমাজ গোষ্ঠীর বন্ধনে অপরাধকারী দালালদের আশ্রয় দেবার ব্যাপক প্রবণতা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। ‘ক্ষমাই মহত্বের লক্ষণ’ এই মহানুভবতার চিরন্তনী আবহে লালিত বাংলার মানস গঠন শাস্তি বিধানের  পরিবর্তে সামাজিক সালিশ ও সমঝোতার পথেই অগ্রসর হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় একই পরিবারের পিতা শান্তি কমিটির সদস্য হয়েছে, অপরদিকে পুত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। পিতা ও পুত্রের এই বিপরীত অবস্থান দীর্ঘদিন আক্রোশ মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধা পুত্র দালাল পিতাকে বাঁচানোর জন্য তদবির শুরু করতে কুণ্ঠিত হয়নি। অনেক দালাল এমনও ছিল যে, তারা গোপনে মুক্তিবাহিনীকে আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে এবং প্রয়োজনমত নিরাপত্তা দিয়েছে। দালালীর অভিযোগে অভিযুক্ত ঐ ব্যক্তিটি পরবর্তীকালে ঐসব মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় প্রার্থনা করেছে এবং আশ্রয় পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত অবস্থায় বা ভিন্নভাবে যাই হোক না কেন, মুক্তিযোদ্ধাগণ প্রায় দুই হাতে ধৃত ও অভিযুক্ত দালালদের ছেড়ে দেবার সুপারিশ করতে থাকে। যা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর দপ্তরকে পর্যন্ত প্রভাবিত করে তোলে। গ্রাম্য সালিশ, দেনদরবার, তদবির হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান ইত্যকার কারণে পরবর্তীকালে কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত বাদীপক্ষগণ মামলা চালাতে উদ্যোগ গ্রহণ হতে পিছিয়ে আসে, এমনকি মামলার ন্যূনতম সাক্ষ্য জোগাড় করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে।”
এটাই ঘটনা। সামাজিক রাজনৈতিকসহ নানা ধরনের সম্পর্ক ও আত্মীয়তার বাঁধন স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর পক্ষ-বিপক্ষকে সমন্বয় ও সমঝোতার দিকে নিয়ে যায়। সৈয়দ আবুল মকসুদ ‘প্রথম আলো’তে তার ‘সহজিয়া কড়চায়’ এই কথাই লিখেছেন এইভাবে, “কোন যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দালালদের বিচার না হওয়ার মূল কারণ, অনেক মন্ত্রী, সাংসদ নেতা ও বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের সহযোগী ছিল। তাদের বাঁচাতে গিয়ে সকলকেই বাঁচিয়ে দেয়া হয়। (প্রথম আলো, ১৩ নভেম্বর, ২০০৭)। শুধু বাঁচিয়ে দেয়া নয়, দীর্ঘ দুই বছর এক মাস সময় পর্যন্ত দালাল আইন বহাল তবিয়তে থাকলেও খুন, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এই চার অপরাধের অভিযোগে মামলা দায়ের না হবার এটাও একটা কারণ।  আরেকটা কারণ হলো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান ছিল কিংবা পাকিস্তান বাহিনীর সহায়ক হিসেবে রাজাকার এর মত যে সব বাহিনী কাজ করেছে, যুদ্ধাপরাধী বা অপরাধী শুধুমাত্র তাদের মধ্যেই ছিল না অন্যান্য দল ও গ্রুপের মধ্যেও যুদ্ধাপরাধী বা অপরাধী ছিল। এ বিষয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন : ‘এখনকার পত্রিকা পড়লে মনে হয় শুধু মুসলিম লীগ, জামায়াত বা নেজামে ইসলামীর লোকেরাই পাকিস্তানীদের দালাল ছিল। বস্তুত সবশ্রেণী ও গোষ্ঠীর মধ্যেই পাকিস্তানীদের সহযোগী ছিল। আব্দুল হক তার কম্যুনিস্ট পার্টির নামের সাথে বাংলাদেশ হবার পরও ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রেখে দেন। অত্যন্ত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ পাকিস্তানীদের সহযোগিতা করছেন। (প্রথম আলো, ১৩ নভেম্বর, ২০০৭)। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপের পরস্পরের মধ্যেও যুদ্ধাপরাধ বা অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। বিভিন্ন বইয়ের বিভিন্ন বিবরণীতে এক দৃষ্টান্ত আছে। সম্প্রতি এটিএন-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী এক দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধী বলতে আমরা জানি একটা ইসলামী দলকে বোঝানো হচ্ছে যারা ডানপন্থী। আমি বলবো যুদ্ধাপরাধীতো সরকারী কর্মচারীও ছিল। আমি আপনাকে প্রমাণ দিতে পারি। কারণ আমি প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। একজন বাঙালী ক্যাপ্টেন মারা যায় সরাইলে। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে হত্যা করে। কিন্তু ঐ ক্যাপ্টেনকে পরে শহীদ উল্লেখ করা হয়। সুতরাং যখন যুদ্ধাপরাধী বলবেন তখন সবাইকে বলতে হবে।’
সবাইকে যুদ্ধাপরাধী বলতে হচ্ছে বলেই স্বাধীনতা উত্তরকালে অবশেষে বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে এগিয়ে যায়নি কেউ। দু’বছর সময়কালে দালাল আইনে মামলা দায়ের না হবার এটাও একটা বড় কারণ। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতাসহ উপরোক্ত সব কারণ সম্মিলিতভাবে ১৯৭৬ সালে দালাল আইন বাতিল করার পটভূমি রচনা করে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কাছে বিষয়টা এইভাবে প্রতিভাত হবার সময়ের দাবী পূরণের অংশ হিসেবেই তিনি দালাল আইন বাতিল করেন। আওয়ামী লীগসহ যারা এ জন্য জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করেন, তারা নিছকই রাজনীতি করেন, বাংলাদেশের সমাজ ও জনগণের কথা, এমনটি তাদের মন কি বলে সেটাও বিবেচনা করেন না।
আসলে একশ্রেণীর সুবিধাবাদীরা এবং আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধাচারণকে তাদের যে রাজনীতি, সে রাজনীতির খোরাক হিসাবেই ব্যবহার করছে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও স্বাধীনতা বিরোধী শ্লোগানকে। এই মনোভাব এই শ্লোগান স্বাভাবিক নয়, সঙ্গতও নয়।
স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে যুদ্ধাপরাধ চ্যাপ্টার ক্লোজ করেছেন এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে নিছক ‘কলাবরেটর’ হওয়াকে শাস্তিযোগ্য করার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত শেখ মুজিবুর রহমানের এসব সিদ্ধান্তকে আমরা যেন এখন অন্যায় অবাঞ্ছিত মনে করছি। এটা যদি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার রাজনীতি হয়, তাহলে আমাদের জানা দরকার জনগণের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি করে স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবই এই রাজনীতিকে অচল করে দিয়ে গেছেন। জনগণও এই সাথে একে সমাধিস্থ করেছে। এই কারণেই দালাল খান-এ-সবুর তিন আসন থেকে নির্বাচিত হন, শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, বিচারপতি নূরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের মনোনীত এমপি প্রার্থী হতে পেরেছিলেন, মাওলানা নূরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ধর্মপ্রতিমন্ত্রী হবার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হয়েছেন। হাজার বলেও যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতা বিরোধী বলে জামায়াতে ইসলামীকে খাটো করা যাবে না। স্বাধীনতা উত্তরকালে তদন্ত করে তৈরি যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় জামায়াতে ইসলামীর কারও নাম ছিল না এবং দালাল আইনে যে ৭৫২ জনের শাস্তি কনফার্ম করা হয়েছিল, এবং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল, তাদের মধ্যেও ছিল না জামায়াতে ইসলামীর কোনো লোক। 
জাতিকে ভাগ করার বিভেদাত্মক এই অভিযান শুধু স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নীতি ও ইচ্ছার ব্যতিক্রম নয়, পৃথিবীর চলমান সংস্কৃতিরও ভায়োলেশন।  আন্তঃজাতি যেমন, তেমনি দেশ জাতির অভ্যন্তরেও সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা অস্বাভাবিক নয়।  তেমনি আবার খুব স্বাভাবিক হলো তাদের সমঝোতা প্রতিষ্ঠা ও সমন্বয়ের ঘটনা।  জাতির স্বার্থেই এটা প্রয়োজন। 
বিভেদের রাজনীতি, হিংসার রাজনীতি আমাদের দেশে তীব্র হোক, এটা বাইরের অনেকেই চায়, যারা চায় আমাদের ভাগ করে শাসন করতে এবং শোষণ করতে। আমরা তাদের  এ চাওয়ার শিকার হতে পারিনা।

Thursday, December 27, 2018

বিজয়ের মাস উপলক্ষ্যে শিবিরের সুন্দর উদ্যোগ।

বিজয়ের মাস উপলক্ষ্যে শিবিরের সুন্দর উদ্যোগ। নাচ-গানের চেয়ে অনেক ভাল ও প্রশংসিত আয়োজন। ধন্যবাদ শিবির: 

Popular Posts